Loading proofofbrain-blog...

বৃদ্ধ বয়সের অবলম্বন

7681120-3x2-940x627.jpg

আমার সহপাঠী একজন অসুস্থ,তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।সন্ধ্যার দিকে ভর্তি করা হয়েছে মেহরাবকে।সন্ধ্যা থেকে দশটা পর্যন্ত মেহরাবের সাথে তাজ আর শরীফ ছিলো।এরপর থেকে মাঝরাত্রি পর্যন্ত আমার থাকতে হবে।তারপর রাত দুইটা-তিনটার দিকে আবার শরীফ যখন আসবে তখন আমি বাসায় যাবো।আমি হাসপাতালে রাতে কোনোদিন থাকিনি।অবশ্য ছোটোসময় একদিন থেকেছিলাম।যেদিন থেকেছিলাম,সেদিন আমার দিদির সিজারের মাধ্যমে বাচ্চা ডেলিভারি করা হয়েছিলো।তখন আমি চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি।দিদির সাথে আম্মা থেকেছিলো,আমি ছোটোমানুষ আমিও সাথে ছিলাম।এরপর আমি কখনওই হাসপাতালে রাতে থাকিনি।রোগীকে দেখতে গিয়েছি,দেখে চলে আসছি।

হাসপাতালে থাকা নিয়ে এতোকিছু বলছি,কারণ ঐদিন মাঝরাত্রি পর্যন্ত থেকে আমার অন্যরকম একটা অভিজ্ঞতা হয়েছে।আমি অবশ্য এখন বেশিরভাগ সময় রোগীর মাঝেই থাকি।এমবিবিএস তৃতীয় বর্ষ থেকে ওয়ার্ডে ক্লাস করতে হয়,সকাল-সন্ধ্যা।কিন্তু ঐদিন রাতের বেলা হাসপাতালে থেকে যে বিষয়টা খেয়াল করেছি,দিনে তা খেয়াল করা হয়ে উঠে না।

যাইহোক,মেহরাবের চিকিৎসা পর্ব শেষ,স্যালাইন,ইনজেকশন দেওয়া শেষ।এখন সে ঘুমুচ্ছে।রাত বারোটার পর পর ধীরে ধীরে সবাই ঘুমাতে যাচ্ছে।রাতে ওয়ার্ডের যারা দায়িত্বশীল, রোগীরা ঘুমানোর পর,তারাও দেখলাম চেয়ারে বা যে যেখানে জায়গা পেয়েছে সেখানে বসে ঘুমুচ্ছে।আমি চুপচাপ মেহরাবের পাশে বসে আছি।মোবাইল ফোনটাও সাথে নাই।মোবাইল ফোনটা তাজ বাসায় যাওয়ার সময় দিয়ে দিলাম তার কাছে,কারণ আমি যখন রাত দুইটার পর বাসায় যাবো,তখন ফোন সাথে থাকা ঝুকিপূর্ণ।ঝুকিপূর্ণ এই অর্থে যে কিছু বখাটে ছেলেপেলে ওভারব্রিজ ঘুরাফেরা করে,যাদের প্রধাণ লক্ষ্য থাকে পথচারীদের মোবাইল ফোন।তাই আমি সেই সময়টা নিজের সাথে ফোন রাখতে চাই নি।

কিন্তু ফোনটা দিয়ে দেওয়াতে এখন বিরক্ত লাগছে।চুপচাপ একজন রোগীর পাশে বসে আছি,সে তো এখন ঘুমুচ্ছে।আমারতো কিছু করার নেই,মোবাইল ফোনটা সাথে থাকলে তাও সময় কাটার একটা ব্যবস্থা হতো।এখন সময় কাটছে না।এমন সময় ভাবলাম,ঘুরে ঘুরে দেখি রোগীরা কে কি করে।বড় লাইট সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।ওয়ার্ডের কিছু কিছু বেডে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে।তাই আমি ঘুরেঘুরে দেখতে লাগলাম।পুরুষ মেডিসিন ওয়ার্ড ছিলো সেটা।দেখলাম নব্বইভাগ রোগীই বৃদ্ধ পুরুষ।এরমধ্যেই একজন বৃদ্ধ কাশতে কাশতে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার অবস্থা।তার স্ত্রী উঠে পানি খেতে দিলো।

এরমধ্যে আরেকজন বৃদ্ধ দেখলাম তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলো,তার স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে ওয়ার্ড বয়কে নিয়ে আসলো।বেডের পাশে থাকা নেবুলাইজার যন্ত্রটা লাগিয়ে দেওয়ার পর ওনি শান্ত হলো।
আরেকজন বৃদ্ধ দেখলাম,রাতের দুইটার দিকে জেগে উঠে বলছে খিদা লাগছে।স্ত্রী উঠে বিস্কুট খেতে দিলো,তারপর পানি খেতে দিলো।এসব দেখে আমার আব্বা-আম্মার কথা মনে পড়লো।আব্বা মারা যাবার কিছুদিন আগে যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন,তারাও হয়তো এমন কান্ডকারখানাই করেছেন।আম্মা রাতে সাথে ছিলেন,আমরা কেউ থাকিনি,আমি আর আমার বোনেরা দিনে দেখে, কাজকর্ম করে চলে আসতাম।আমার মনে হলো,আম্মাও আব্বার এইভাবে সেবা করতেন।

আমি ঐদিন রাতে একটা বিষয় লক্ষ্য করলাম যে প্রত্যেকটা বৃদ্ধের সাথে তার সেবার জন্য এখানে এই রাত্রিবেলা যে উপস্থিত সে তার স্ত্রী,সেই বৃদ্ধের আদরের মেয়েও না বা ছেলেও না।তাকে এই বৃদ্ধ বয়সে সেবা করছে তার স্ত্রী।বেশিরভাগ বৃদ্ধের সাথেই তাদের স্ত্রীরা রয়েছেন।সবার স্ত্রীদের বয়স বৃদ্ধগণের চেয়ে দশ-বিশ বছরের কম হবে।তাই তারা এখনও স্বামীর সেবা করতে পারছেন।

বৃদ্ধ বয়সে মানুষ অন্যের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন।বৃদ্ধ পুরুষরা দেখা যায় এসব ক্ষেত্রে স্ত্রীর উপর নির্ভরশীল থাকেন।তখন স্ত্রীদের সেবা ছাড়া তারা চলতে পারেন না।বৃদ্ধ পুরুষদের দেখা যায়,বৃদ্ধ বয়সে কম কষ্ট হয়।কারণ তারা স্ত্রীদের সেবা পান।কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়,স্বামীরা মারা যাবার পর স্ত্রীরা বেঁচে থাকেন।তখন স্ত্রীদের সেবা করার কেউ থাকে না।

সে যাইহোক,রাত দুইটা পর্যন্ত আমার চোখে শুধু এই দৃশ্যগুলোই পড়লো।বৃদ্ধ শক্তিহীন,নির্ভরশীল পুরুষকে তাদের স্ত্রীরা সেবা করছেন।দুইটার পর শরীফ চলে আসলে,আমি বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।এর মধ্যে,রাস্তার ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।নিস্তব্ধ শহর।ফুটপাতেও দেখলাম দুই বুড়া-বুড়ি শুয়ে আছেন।এর মধ্যে আরেকটু সামনে যেতেই দেখি,এক বৃদ্ধ মনে হয় রাত্রি বেলা অসুস্থ হয়ে পড়াতে তাকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে রিক্সায় করে,রিক্সাতে তাকে ধরে বসে আছেন যে মহিলা,ওনি তার স্ত্রী ব্যতিরেকে আর কেউ নন,যদিও পিছনের রিক্সায় তার সন্তানেরা আছেন দেখলাম।

এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাসার সামনে হাজির হলাম।বাসার মেইন গেইটে তালা লাগানো ভিতর দিয়ে,আমার কাছে চাবি আছে অবশ্য।কিন্তু তালা খুলতে হবে ভিতর থেকে।দাড়োয়ানের রুমের দিকে গেলাম,বৃদ্ধ দাড়োয়ান শুয়ে আছে ছোটো চৌকির উপর, চৌকির নিচ বরারবর তার বৃদ্ধ স্ত্রী শুয়ে আছেন।আমি আর তাদের ডাক দিয়ে বিরক্ত করলাম না,দেয়াল টপকিয়ে পার হয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম, সিঁড়ির সামনের গেইটের কাছে পৌঁছালাম...

H2
H3
H4
3 columns
2 columns
1 column
Join the conversation now